পায়রা বন্দরের সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার ড্রেজিং প্রকল্প জলে

দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর পায়রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে করা ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প কার্যত ভেস্তে গেছে।
বছর না যেতেই বন্দরের চ্যানেল আবারও আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। গভীরতা কমে যাওয়ায় এখন আর বড় কোনো বিদেশি জাহাজ ভিড়তে পারছে না বন্দরে।
চরম ডলার সংকটের মধ্যেই ২০২২ সালে রিজার্ভ থেকে নেয়া হয় বিপুল এই অর্থ। ২০২৩ সালের মার্চে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ হস্তান্তর হয়। তখন জানানো হয়, চ্যানেলের গভীরতা বেড়ে হয়েছে ১০ দশমিক ৫ মিটার, যা ৪০ হাজার ডেডওয়েট টনের জাহাজ চলাচলের উপযোগী। কিন্তু মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে আবারও চ্যানেলে পলি জমে গভীরতা নেমে এসেছে গড়ে ৬ দশমিক ৫ মিটারে।
ড্রেজিংয়ের পরও কার্যত কোনো সুফল মেলেনি। কারণ, তখনও বন্দরের প্রথম টার্মিনালের কাজ ছিল অসম্পূর্ণ। ফলে চ্যানেলে বড় জাহাজ প্রবেশ করতে পারলেও তারা জেটিতে ভিড়তে পারেনি। বাধ্য হয়ে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পণ্য খালাস করতে হয়েছে আগের মতোই।
পায়রা বন্দরের বর্তমান গভীরতা অনুযায়ী, ভাটার সময় এটি গড়ে ৫ দশমিক ৯ মিটার, জোয়ারে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৫ মিটার পর্যন্ত উঠে। এই গভীরতায় বড় কোনো বিদেশি মাদার ভ্যাসেল ভিড়তে পারে না। ফলে বন্দর ব্যবহারের কার্যকারিতা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মাসুদ ইকবাল বলেন, “ড্রেজিংয়ের সময় বন্দরটি পুরোপুরি সচল না করাটা ছিল একটি বড় ব্যর্থতা। প্রকল্পের সব অর্থ জলে গেছে বলা যেমন ঠিক না, তেমনি পুরোটা ফলপ্রসূ হয়েছে তাও বলা যায় না।”
ড্রেজিং প্রকল্পের ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২০ সালে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং প্রকল্পে ব্যয় হয় ৪১৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এরপর ২০২৩ সালে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পে ব্যয় হয় প্রায় ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ দুই ধাপে ড্রেজিংয়ের পেছনে খরচ হয় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে, বন্দর চালুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৫২৯টি বিদেশি এবং ৩ হাজার ৪২৬টি দেশীয় লাইটারেজ জাহাজ পণ্য খালাস করেছে। এর বিপরীতে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। যা ড্রেজিং ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশেরও কম।
এ অবস্থায় বন্দর ঘিরে বিনিয়োগ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হলেও ব্যবসায়ীরা এখনো আশাবাদী। বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক মামুনুর রশিদ বলেন, “ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে পায়রা বন্দরের সম্ভাবনা অনেক বেশি। তবে এটা বাস্তবে কাজে লাগাতে হলে নিয়মিত ড্রেজিং এবং টার্মিনাল নির্মাণসহ অবকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে।”
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, “আমরা বিনিয়োগে আগ্রহী, কিন্তু তা নির্ভর করছে এই বন্দরের টেকসই ব্যবস্থাপনার ওপর। শুধু কাগজে নয়, বাস্তবেও কার্যকর হতে হবে এসব প্রকল্প।”
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ধরনের প্রকল্পে আগে অবকাঠামো ও ব্যবহারযোগ্যতা নিশ্চিত না করে কেবল গভীরতা বাড়ানোর নামে ব্যয় করলে তা জনসম্পদের অপচয় হয়ে দাঁড়ায়।
অতীত থেকে বর্তমান: পায়রা বন্দরের চ্যানেল গভীরতা
•২০১৬ (প্রাকৃতিক): ৬.৩ মিটার
•২০২৩ (ড্রেজিং পরবর্তী): ১০.৫ মিটার
•২০২৪ (বর্তমান): ৬.৫ মিটার
ড্রেজিং প্রকল্পের লক্ষ্য ও বাস্তবতা
•টার্গেট গভীরতা: ১০.৫ মিটার
•লক্ষ্য ছিল: ৪০ হাজার ডেডওয়েট টনের জাহাজ চলাচল
•বর্তমান বাস্তবতা: সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টনের কয়লাবাহী জাহাজ চলাচল করছে
ব্যয় ও রাজস্ব হিসাব
•রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং (২০২০): ৪১৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা
•ক্যাপিটাল ড্রেজিং (২০২৩): ৬,৫০০ কোটি টাকা
•সরকারের মোট আয়: ২,০৭৯ কোটি টাকা
বিশ্লেষকরা মনে করেন, কার্যকর পরিকল্পনা ও প্রয়োগের অভাবে এই প্রকল্প একদিকে যেমন ভেস্তে যাচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে ফেলছে। সময়মতো পুনঃড্রেজিং না হলে ভবিষ্যতেও এই বন্দর ব্যবহারে অনাগ্রহ বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

- বিজ্ঞাপন -

আপনার মন্তব্য লিখুন

- Google -

আরও পড়ুন

Back to top button