সালাউদ্দিন-২ লঞ্চডুবির ২৩ বছর, ভাসে এখনো বিভীষিকার ছবি

 

- বিজ্ঞাপন -

২০০২ সালের ৩ মে। স্মৃতিতে আজও বিভীষিকাময় এক রাত। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী, দশমিনা ও গলাচিপা উপজেলার মানুষের হৃদয়ে গভীর শোকের দিন। এই দিনে সংঘটিত হয়েছিল দেশের ইতিহাসের অন্যতম মর্মান্তিক নৌ-দুর্ঘটনা ‘সালাউদ্দিন-২’ লঞ্চ ট্রাজেডি। সেই ভয়াবহ দিনটির আজ ২৩তম বার্ষিকী। সময় বয়ে গেছে, কিন্তু ক্ষত এখনো শুকায়নি। পরিবার হারানো স্বজনদের চোখে আজও অশ্রু ঝরে, ভুলতে পারেনি কেউ।

সেই ভয়াল রাত:
২০০২ সালের ৩ মে মধ্যরাতে ঢাকা থেকে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীগামী যাত্রীবাহী লঞ্চ ‘এমভি সালাউদ্দিন-২’ শরীয়তপুরের নরসিংপুর এলাকার কাছে মেঘনা নদীতে ভয়াবহ ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। এসময় লঞ্চটিতে ছিল আনুমানিক ৩৫০ থেকে ৪০০ যাত্রী। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেও যাত্রী বোঝাই করে লঞ্চটি যাত্রা করায়, শুরুর দিকেই এর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে লঞ্চটিতে পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট বা উদ্ধার সামগ্রীও ছিল না।

প্রাণহানি ও নিখোঁজ:
সরকারি হিসাবে প্রায় ১৬০ জনের প্রাণহানি ঘটে, তবে স্থানীয় সূত্র মতে এ সংখ্যা ছিল আরও বেশি। অনেকের মরদেহই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। নিখোঁজ বহু মানুষ আর কোনোদিন ফিরে আসেনি। নিহতদের বেশিরভাগই ছিলেন রাঙ্গাবালী, গলাচিপা ও দশমিনা উপজেলার সাধারণ মানুষ। কেউ চিকিৎসা নিতে, কেউবা জীবিকার খোঁজে ঢাকা গেছিলেন।

ছবিতে লেখা ইতিহাস:
লঞ্চটি মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ে ডুবে যাওয়ার পর যেভাবে উদ্ধার করা হয়েছিল। তার এক মর্মস্পর্শী প্রমাণ এই ছবিটি। সংযুক্ত ছবিতে দেখা যায়, নদীর গভীর থেকে তুলতে চেষ্টা চলছে ডুবে যাওয়া সেই লঞ্চটিকে। কপিকলের ভারী শিকলে জড়িয়ে টেনে তোলা হচ্ছে মৃতপ্রায় সালাউদ্দিন-২। পাশে দাঁড়িয়ে হাজারো চোখ—যারা প্রিয়জনের লাশ খুঁজছে, কিংবা বিস্ময়ে দেখছে বিভীষিকার বাস্তব রূপ।
উদ্ধারের সময় যেসব ছবি ধারণ করা হয়েছিল, তা আজও স্থানীয় মানুষের স্মৃতিতে তীব্রভাবে জেগে আছে। আজকের তরুণ প্রজন্ম এই ছবি দেখে ইতিহাস জানতে পারে। অনেকেই প্রতব বছর ফেসবুকে করুণ ইতিহাস তুলে ধরে স্টাটাস দেন। কিন্তু স্বজনহারাদের চোখে এখনো সেই রাতের ঘূর্ণিঝড় বয়ে চলে।

- বিজ্ঞাপন -

বেঁচে ফেরা এক যাত্রীর চোখে বিভীষিকা:
ওই লঞ্চের যাত্রী ছিলেন মো. মাসুম মাহমুদ, তিনি জানালেন তার বেঁচে ফেরা ও সেদিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। তখন আমার বয়স মাত্র ১২ কি ১৩। কোন ক্লাসে পড়ি সঠিক মনে নেই।
আজ থেকে ২৩ বছর আগের ঘটনা। সেদিন যদি মারা যেতাম আজ ২৩ বছর পূর্ণ হতো। সেদিনের সেই লোমহর্ষক ঘটনা মনে হলে আজও ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। তখন আমি রাঙ্গাবালিতে ছোটবাইশদিয়া গ্রামে বাবা মায়ের সাথে থাকতাম।
গ্রামের এক দুলাভাই এর সাথে নারায়ণগঞ্জ বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ৩ মে সালাউদ্দীন-২ লঞ্চে করে বাড়ি ফিরছিলাম। সেদিন
বৃষ্টি হচ্ছিল আগে থেকেই। শরীরটাও ভালো ছিলো না। মনে পড়ে কাথা গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেলো। এর মধ্যে টের পেলাম লঞ্চ কাত হয়ে পানিতে পড়ে গেছে। লঞ্চের মধ্যে পানি ঢুকতেছে। কিছুই বুঝতে পারলাম না। আল্লাহ কিভাবে যেনো আমাকে লঞ্চের ভিতর থেকে বের করে বাইরে বের করে এনেছেন।
তারপর মনে পড়ে পানিতে অন্ধকারে সাঁতরাচ্ছি। এরমধ্যে লঞ্চ পুরো উল্টে গেছে। লঞ্চের তলা ধরতে চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু পিচ্ছিল সেজন্য ধরে রাখতে পারছিলাম না। এরপর কতক্ষণ সাঁতার কেটেছি জানিনা। কোনদিকে সাঁতরে ছিলাম তাও জানিনা। মনে আছে গায়ে একটা হাফ শার্ট ছিলো সেটা টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। হালকা পাতলা ছিলাম তাই হয়তো আল্লাহর রহমতে সাঁতরাতে পারছিলাম। আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় নদীতে কোন নৌকা বা ট্রলারও ছিলোনা যে আমাদের উদ্ধার করবে।
হঠাৎ দূরে দেখি আলো সেদিকে সাঁতরাচ্ছি। দেখলাম একটা লঞ্চ থামানো। সেটার দিকে গেলাম। ততক্ষণ অক্ষত ছিলাম। সেই লঞ্চ থেকে বড় বড় রশি ফেলছিলো আমাদের উদ্ধার করার জন্য। রশিতে হাতের আঙুলে মারাত্মক ব্যাথা পেলাম, তবুও ছাড়িনি। শক্ত করে রশি ধরলাম টেনে তুললো আমাকে লঞ্চে। ক্লান্ত শরীর আমাদের বসিয়ে রাখলো ইঞ্জিনের পাশে কারন আমাদের শরীর একদম ঠান্ডা ছিলো। এরপর একটা গামছা দিলো আমাকে সেটা জড়িয়ে বসে ছিলাম।
আমার সাথের তিনজনের দুজনকেও এ লঞ্চে দেখলাম। পরে জানতে পারি বাকি আরেকজন মারা গিয়েছে।
অসহায় দশা আমাদের লঞ্চের যাত্রীদের কাছ থেকে আমাদের টাকা তুলে দেয়া হয়েছিলো। লঞ্চটা ছিলো ঝালকাঠি লাইনের। সকালে বরিশালের দপদপিয়াতে আমাদের নামিয়ে দেয়া হলো। সেখানে এক লোক আমাদের নাস্তা করালো।
কত কঠিন দশা ছিলো আমাদের ভাষায় প্রকাশ করার মত না। তার উপর পোষাকের ওই অবস্থা।
সেখান থেকে আমাদের বাসে তুলে দেওয়া হলো তারাতো বিশ্বাস করেনা আমাদের এই অবস্থা। তারা আমাদের বাসে নিতেই চাইলো না।
তারপরে নিলো তাও বাসের ছাদে। এরপর বাসে আমরা পটুয়াখালী গেলাম সেখান থেকে রাঙ্গাবালী গেলাম লঞ্চে। পরের দিন বাড়ি পৌঁছালাম।

বাড়িতে বাবা আমাকে দেখে বাবা কান্নায় ভেঙে পড়লো। মা অনেক অসুস্থ ছিলো তবে তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন আমার কিছু একটা হয়েছে। তিনিও কাঁদতে ছিলেন বারবার।
মহান আল্লাহর দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া তিনি আমাকে এই মহা বিপদ থেকে রক্ষা করে আজ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছেন।
পরে জানতে পারি ওই ছোট লঞ্চে প্রায় ৪শ যাত্রী ছিলো। তারমধ্যে সাড়ে তিন’শ এর বেশি যাত্রী মারা যায়। বেঁচে যাওয়া সৌভাগ্যবানদের মধ্যে আমি একজন।

সেই লঞ্চে ছিলেন রাঙ্গাবালী উপজেলার বাহেরচর গ্রামের বাহারুল সিকদারের নববধূ। বিয়ের মাত্র কিছুদিন পরই ঢাকা থেকে গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। সেই দিন হারিয়ে ফেলেন তার প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনীকে।
বাহারুল জানান, আমার বউ তখনো ঠিকমতো সংসার শুরু করতেই পারেনি। একসঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন, অথচ সেই স্বপ্ন ভেসে গেলো মেঘনার জলে। আজ ২৩ বছর হয়ে গেছে, কিন্তু আজো চোখের সামনে ভাসে সেই দৃশ্য।
তিনি জানান, লঞ্চটা ছিল পুরনো, ছিদ্র আর ভারি বোঝাই। তারপরও ছাড়তে দেওয়া হলো। এখনো এর বিচার পাইনি।

বিচারহীনতার দীর্ঘশ্বাস:
দুর্ঘটনার পর গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। ওঠে নিরাপত্তার ঘাটতির অভিযোগ। বলা হয়, লঞ্চটি ছিল অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই এবং জীর্ণ। কিন্তু দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও কারো শাস্তি হয়নি। আজও সেই রুটে কিছু পুরোনো, অনিরাপদ লঞ্চ চলাচল করে চলেছে নিয়ম, নীতিমালা ও জীবনের মর্মবাণী উপেক্ষা করে।

স্থানীয়রা বলছেন, সালাউদ্দিন-২ লঞ্চ ডুবি শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি অব্যবস্থাপনা, অবহেলা ও জবাবদিহির চরম অভাবের প্রতীক।
নিহতদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। আল্লাহ যেন তাঁদের শহীদের মর্যাদা দান করেন।

আপনার মন্তব্য লিখুন

- Google -

আরও পড়ুন

Back to top button