বড় ভূমিকম্প ঝুঁকিতে দেশ

দ্বিতীয় দিনের মতো ভূমিকম্পে কাঁপল দেশ। শনিবার সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে ভূমিকম্পটি অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩। প্রথম পর্যায়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পক্ষে এর উৎপত্তিস্থল সাভারের বাইপাইল জানানো হলেও পরে এটি নরসিংদীর পলাশে হয়েছে বলে নিশ্চিত করা হয়। এরপর সন্ধ্যায়ও ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে রাজধানী। সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিটে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩। উৎপত্তিস্থল নরসিংদী থেকে ১১ কিলোমিটার পশ্চিমে। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্য মতে, ভূমিকম্পের উৎপত্তি ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়ছে, এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার বাড্ডায়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩।
ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুক্রবারের ভূমিকম্পে প্লেটগুলো আনলকড হয়ে গেছে। এখন তারা শক্তি বের করছে। এর মানে দেশে ভূমিকম্প চলতেই থাকবে। যতক্ষণ না বড় ভূমিকম্প সংগঠিত হয়। আর এর ফলে ঢাকার অস্তিত্ব মারাত্মক সংকটে পড়তে পারে।
এদিকে ভূমিকম্পের আফটার শকে দেশবাসীর মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভূমিকম্পের পর থেকে ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ভুক্তভোগী নাগরিকরা ফোন করছেন। শনিবার সন্ধ্যার পর মৃদু ভূমিকম্পে রাজধানীবাসীর অনেকে বাড়ি ছেড়ে সড়কে নেমে আসেন। ধানমন্ডি, বনানী, মিরপুর, বাড্ডা ও গুলশান এলাকায় এমন চিত্র দেখা গেছে। নগরবাসী জানায়, যত্রতত্র ভবনে কোথাও নিরাপদে থাকার উপায় নেই। সড়কের পাশেও বড় বড় দালান। ভূমিকম্পের আগাম সতর্কতা না থাকায় শিশু-বৃদ্ধদের নিয়ে বেশি আতঙ্ক কাজ করছে।
শনিবার বিকেলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, তাঁদের আগের বিশ্লেষণে একটু সমস্যা হয়েছিল। বাইপাইলে নয়, নরসিংদীর পলাশে আজ সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৩ মাত্রার মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে। এদিন বিকেল ৪টার দিকে  ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের পেশাগত সহকারী নিজাম উদ্দিন আহাম্মাদ সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রিখটার স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩। ঢাকার ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে ২৯ কিলোমিটার দূরে নরসিংদীর পলাশে এর উৎপত্তিস্থল।
ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে থাকার কারণে এই অঞ্চলে ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে। দুটি প্লেটের (ভারত ও বার্মা) সংযোগ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। সেটি সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ হাওড় ও মেঘনা নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে গেছে। এর পূর্ব প্রান্তটি বার্মা প্লেট ও পশ্চিম প্রান্তটি ইন্ডিয়ান প্লেট। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দুটো প্রধান ভূমিকম্পের উৎস রয়েছে। একটি হচ্ছে ডাউকি ফল্ট। এই অংশে বড় বড় ভূমিকম্প হয়ে শক্তিটি বের হয়ে গেছে। কিন্তু পূর্ব প্রান্তে এখনো গেল ৫০০ বছরে কোনো ভূমিকম্পের নজির নেই। পূর্ব প্রান্তটা একটি ভূমিকম্পের বৃহৎ উৎস।

- বিজ্ঞাপন -

যেখানে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। সমতলে যেটি অবস্থিত সেটাকে সাবসডাকশন অঞ্চল বলা হয়। সেখানে প্লেটের পরস্পরমুখী যে গতি তা পরিমাপ করে দেখা গেছে, আট মাত্রার অধিক শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়ে আছে। যে কোনো সময় এই ভূমিকম্পটি সংঘটিত হতে পারে। সেটি একবারেও হতে পারে, আবার ধীরে ধীরেও হতে পারে।
চলতি বছরেই মিয়ানমারে সাগাইং ফল্ট লাইনের ওপর শুক্রবার ছয়টি ভূমিকম্প আঘাত হানে। যা আশপাশের সব শহরের জন্যই কঠিন সতর্কবার্তা। সাগাইং ফল্ট ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোনের অংশ, যেখানে বাংলাদেশও অবস্থান করছে। মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের ভূমিকম্পগুলোর মাত্রা ৪.৫ থেকে ৭.৭ পর্যন্ত ছিল, যা বিভিন্ন ভবনের ক্ষতি করেছে। ৭০০ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে। ভূতাত্ত্বিকরা বলছেন, এই ভূমিকম্প ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোনে ঘটেছে। সেখানে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শক্তি জমা হচ্ছে এবং আমরা আশঙ্কা করছি, ওখানে ৯ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হতে পারে।
এ বিষয়ে ভূতত্ত্ববিদ ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার জনকণ্ঠকে বলেন, সাবসডাকশন জোনে যে বিপুল শক্তি সঞ্চিত রয়েছে সেটি নিশ্চিত, ভূমিকম্প হবে সেটিও নিশ্চিত। গত শুক্রবার ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূকম্পনের অর্থ দাড়ায়, প্লেটগুলো আনলকড হয়ে গেছে। এখন যে বিপুল পরিমাণ শক্তি জমা আছে তা বের হতেই থাকবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি জানান, পানির পাইপ ছিদ্র হলে সেটি দিয়ে অল্প পানি বের হয়। এরপর পানির লাইন থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শনিবার টানা দ্বিতীয় দিনের কম্পন এমন নির্দেশনা দিচ্ছে। এই ভূতত্ত্ববিদ আরও বলেন, বড় ভূমিকম্প আগামীকালও হতে পারে আবার ৬ মাস পরও হতে পারে। তবে এখন যেগুলো হচ্ছে তা শুধুই সতর্কবার্তা।
ইতিহাস বলে এখানে হাজার বছরের মধ্যে বড় ভূমিকম্প হয়নি। এখানে যে শক্তি জমা হয়ে আছে তা ক্রমান্বয়ে আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন যে ছোট ছোট ভূমিকম্প হচ্ছে সবই সাবসড্রাকশন অঞ্চলের মধ্যে। যে বিপুল শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে তার বের হওয়ার চেষ্টা বা প্রবণতা ইঙ্গিত করে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রুবায়েত কবির জানান, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ২৮টি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪১ এবং ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪-তে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই বেশকিছু ভূকম্পন রেকর্ড করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ সক্ষমতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেড়েছে। তবে তথ্য বলছে, ভূমিকম্পের সংখ্যাও বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, এই অঞ্চলে খুবই মৃদু ভূমিকম্প নিয়মিত হয়।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তির সময়কাল ১২৫ থেকে ১৭৫ বছর এবং ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ২৫০ থেকে ৩০০ বছর। ১৭৬২ সালে চট্টগ্রামে ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প, ১৮৬৯ সালে চাছাড়ে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প, ১৮৮৫ সালে ৭ মাত্রার বঙ্গ ভূমিকম্প, ১৮৯৭ সালে ৮.৭ মাত্রার ভারতের বিশাল ভূমিকম্প, ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প, ১৯২৩ সালে দুর্গাপুরে ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প এবং ১৯৩০ সালে ধুবরিতে ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘কাজেই, বড় ধরনের ভূমিকম্পের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকা উচিত।
উচ্চ ঝুঁকিতে ঢাকা ॥  ভূতাত্ত্বিক অবস্থান, জনসংখ্যার ঘনত্ব ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ের কারণে ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ঢাকা আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে এমন শীর্ষ ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। জনসংখ্যার ঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণ, অপ্রশস্ত সড়ক অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির অভাবই এ ঝুঁকি তৈরি করেছে। মাঝারি থেকে প্রবল মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে পড়ার শঙ্কায় পড়বে রাজধানী।
হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) এক গবেষণা বলছে, ঢাকায় যত কংক্রিটের ভবন বিদ্যমান তার ৫৬ দশমিক ২৬ শতাংশ রয়েছে ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকির মধ্যে। মাঝারি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ৩৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ ভবন। তুরস্ক ও সিরিয়ায় সাম্প্রতিক বছরে যে মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে, তাতে ঢাকার ৮০ শতাংশ ভবন ধসে পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা।
বড় ধরনের ভূমিকম্পে ধসে পড়ার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে, এমন ভবনের পরিমাণ ১৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। এসব ভবনকে ‘ই’ ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করা হয়েছে এইচবিআরআইয়ের গবেষণায়। ‘ডি’ ক্যাটাগরিতে ধসে পড়ার মাঝারি ঝুঁকিতে রয়েছে ২১ দশমিক ৬২ শতাংশ ভবন। ক্ষতি হলেও ধসে পড়বে না এমন ভবনকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘সি’ ক্যাটাগরিতে। এমন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পরিমাণ ৪৩ দশমিক ২৪ শতাংশ।
নরসিংদী ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, শুক্রবারের ভূমিকম্পে নরসিংদী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় কম-বেশি দেড় শতাধিক কাঁচা-আধাপাকা ও বহুতল ভবনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সচেয়ে বেশি ভবনে ফাটল ধরেছে পলাশ উপজেলায়। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আবুবক্কর সিদ্দিকী জানান, ৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকায় ৩০টি ভবনের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিস্তারিত জানার জন্য কন্ট্রোল চালু করা হয়েছে। নরসিংদী জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানান, ভূমিকম্পে নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ২৫ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়েছে।

তবে আহতদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। জেলায় প্রায় শতাধিক ঘরবাড়ির আংশিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। প্রায় শতাধিক লোক আহত হয়েছে। তবে গুরুতর আহতের সংখ্যা কম। ভূমিকম্পের জন্য বন্ধ থাকা ঘোড়াশাল সার কারখানা এবং ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এখনো চালু করা হয়নি। শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আ. স. ম উবাইদুল্লাহ নরসিংদীতে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত  এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছেন এবং পরীক্ষার জন্য মাটি সংগ্রহ করেছেন।
এর আগে শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটের ভয়াবহ ভূমিকম্পে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ভবন থেকে তাড়াহুড়া করে নামার সময় অন্তত শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু আহত হয়েছে। এই ঘটনায় পিতা-পুত্রসহ মোট পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। ইতোমধ্যেই সকলের দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি অন্তত শতাধিক ভবন ও বাড়ি-ঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে ভূমিকম্পের ফলে। সকল উপজেলা ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্মকর্তারা এসব ক্ষতি নিরূপণে কাজ করে যাচ্ছেন।

তথ্য:  আসিফ হাসান কাজল, জনকন্ঠ।

- বিজ্ঞাপন -

আপনার মন্তব্য লিখুন

- Google -

আরও পড়ুন

Back to top button