তরুণদের মধ্যেও বাড়ছে হৃদরোগের প্রকোপ

একসময় হৃদরোগকে বলা হতো বয়সী মানুষের অসুখ। ধারণা করা হতো, চল্লিশ বা পঞ্চাশের পর মানুষ হৃদরোগে ভোগে। কিন্তু এখনকার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। চিকিৎসকরা বলছেন, গত এক দশকে তরুণদের মধ্যেও হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। অনেকে বিশ কিংবা ত্রিশের কোঠাতেই হার্ট অ্যাটাকের শিকার হচ্ছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বা কর্মজীবনের একেবারে শুরুর দিকের তরুণদের মধ্যেও হঠাৎ মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে।

- বিজ্ঞাপন -

এ অবস্থার পেছনে রয়েছে জীবনযাত্রার পরিবর্তন। আধুনিক প্রযুক্তি মানুষকে যেমন সহজ জীবন দিয়েছে, তেমনি শারীরিক পরিশ্রম কমিয়ে দিয়েছে। তরুণদের অনেকেই এখন দিনের বড় একটি সময় বসে কম্পিউটার বা মোবাইলের পর্দার সামনে কাটান। নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যাস নেই, সঠিক সময়ে খাবার খান না, আবার অনেকে জাঙ্ক ফুডের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। অতিরিক্ত তেল-চর্বি, প্রক্রিয়াজাত খাবার ও কোমল পানীয় শরীরে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল জমিয়ে হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করছে।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মানসিক চাপ। পড়াশোনার প্রতিযোগিতা, চাকরির অনিশ্চয়তা, ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা, সম্পর্কের টানাপোড়েন— সব মিলিয়ে তরুণদের মানসিক চাপ বেড়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক চাপ ও অনিদ্রা সরাসরি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ঘুম কম হলে শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়, যা রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দনে প্রভাব ফেলে। তরুণদের অনেকেই রাত জেগে কাজ বা পড়াশোনা করেন, আবার কেউ কেউ স্রেফ মোবাইল ব্যবহার বা গেম খেলে রাত কাটান। এর ফলে শরীর পর্যাপ্ত বিশ্রাম পায় না, হৃদযন্ত্রও স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না।

ধূমপান ও মাদকও তরুণদের হৃদরোগের বড় শত্রু হয়ে উঠেছে। সিগারেট, ই-সিগারেট, ইয়াবা বা অন্যান্য মাদকদ্রব্য শুধু ফুসফুস নয়, সরাসরি হৃদযন্ত্রকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেক তরুণ অল্প বয়সেই আসক্ত হয়ে পড়ছেন। নিয়মিত ধূমপান রক্তনালী সংকুচিত করে, রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত করে এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।

চিকিৎসকেরা বলছেন, হৃদরোগ এখন আর বয়স দেখে আসে না। জেনেটিক কারণও অনেক সময় দায়ী থাকে। যদি পরিবারের কারও হৃদরোগ থাকে, তবে তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে জীবনযাত্রায় সঠিক পরিবর্তন আনলে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম, স্বাস্থ্যকর খাবার, ধূমপান-মাদক থেকে দূরে থাকা এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা— এসব বিষয় মানলে তরুণরা হৃদরোগ থেকে রক্ষা পেতে পারেন।

- বিজ্ঞাপন -

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে হৃদরোগের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। এর মূল কারণ হলো খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রা। ভাজাপোড়া খাবার, গরু-খাসির চর্বিযুক্ত মাংস, অতিরিক্ত লবণ এবং কম শারীরিক পরিশ্রম হৃদরোগের প্রকোপ বাড়াচ্ছে। শহরে বসবাসকারী তরুণদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও বেশি। যানজট, দুশ্চিন্তা, দূষণ ও ব্যায়ামের অনুকূল পরিবেশের অভাব সবকিছু মিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতিবছর কোটি কোটি মানুষ হৃদরোগে মারা যায়। এর একটি বড় অংশ তরুণ বয়সী। বাংলাদেশেও এখন হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে বিশ ও ত্রিশের কোঠার রোগীদের ভিড় বেড়ে গেছে। আগে যেখানে রোগীর গড় বয়স হতো পঞ্চাশের ওপরে, এখন সেখানে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা কর্মজীবনের শুরুতে থাকা তরুণ।

এই প্রবণতা থামাতে হলে ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি পরিবার ও সমাজকেও ভূমিকা রাখতে হবে। ছোটবেলা থেকেই স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা গড়ে তোলা দরকার। শিশু-কিশোরদের মোবাইল বা টিভির সামনে বসিয়ে রাখার বদলে খেলাধুলায় উৎসাহিত করতে হবে। তরুণদের জাঙ্ক ফুডের প্রতি আসক্তি কমাতে হবে, সহজলভ্য করতে হবে ফলমূল ও শাকসবজি। কর্মস্থলেও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কর্মীরা শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকতে পারেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সচেতনতা। তরুণদের বুঝতে হবে হৃদরোগ শুধু বয়সী মানুষের সমস্যা নয়, বরং এখন তাদের নিজেদের জীবনেও বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সঠিক খাবার ও ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক প্রশান্তি হৃদরোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। অল্প বয়সেই জীবন শেষ হয়ে যাক, এটা কেউ চায় না। তাই তরুণদের নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য এখন থেকেই সচেতন হতে হবে।

তরুণ সমাজই দেশের শক্তি। যদি তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে, তবে শুধু ব্যক্তিগত জীবন নয়, গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই হৃদরোগের বাড়তি ঝুঁকি ঠেকাতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। সুস্থ জীবনযাপনই পারে তরুণদের হৃদয়কে রক্ষা করতে এবং তাদের স্বপ্নকে দীর্ঘায়িত করতে।

আপনার মন্তব্য লিখুন

- Google -

আরও পড়ুন

Back to top button